About us

আমাদের সন্তান বাঁচে দুধে ভাতে  এই নিয়ে আমি যাব মজলুম মানুষের কাছে।


অসীম সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ আজ এক গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। পতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে একে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে হলে ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১ সালে যেরকম পরিবর্তন হয়েছিল, ভৌগোলিক অর্থে নয়, রাজনৈতিক অর্থে তার চেয়েও বড়ো পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের উদ্ধার পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।


এদেশের মুসলমান আর নিম্নবর্ণের হিন্দুরা একসময় ব্রিটিশ আর তাদের সৃষ্ট জমিদারদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। ১৯৪৬ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে প্রায় ৯৪ শতাংশ ভোট দিয়ে ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের মতো একটি অবিশ্বাস্য রাষ্ট্রপ্রকল্পকে তারা রাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই ভূভাগের মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, পাকিস্তান বানানোর মাধ্যমে জমিদার আর ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব হলেও ইসলামের নামে পশ্চিম-পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের উপর আরো জঘন্য কায়দায় চেপে বসেছে। এরপর ভাষা-আন্দোলন, শিক্ষা-আন্দোলন, সংবিধান-বিরোধী আন্দোলন, সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদির ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফার পথ ধরে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এরপর রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে এদেশের মানুষ একটি স্বাধীন দেশ অর্জন করতে সক্ষম হয় ১৯৭১ সালে।


কিন্তু স্বাধীনতার পর মানুষের আশাভঙ্গ হতেও বেশী সময় লাগেনি। একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ একটি শাসকদলের অত্যাচারের বিপরীতে আর-একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোকেই রাজনৈতিক সমাধান হিসাবে বিবেচনা করে এসেছে। কিন্তু ভয়াবহ-সব অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষকে এ বিভ্রম থেকে অনেকটা মুক্তি দিয়েছে। বর্তমানে তারা অনেকটাই স্পষ্ট যে, একটি দলের বদলে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসালে, এমনকি দেশ ভেঙে আর-একটি দেশ বানালেও শোষণ-নির্যাতন শুধু অভিন্ন থাকতে পারে তা-ই নয়, এমনকি তা আরো তীব্র ও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত কোনো দলীয় সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া বর্তমানে কেউ বিশ্বাস করে না যে বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ দুর্যোগ থেকে দেশকে উদ্ধার করা সম্ভব, তা সেই দল ডান-বাম-মধ্যপন্থী বা ধর্মব্যবহারকারী যে লেবাসেরই হোক-না-কেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের সামনে এসব দলের বাইরে কোনো গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দিক-নির্দেশনামূলক কর্মসূচীও নেই। ফলে এমন এক ভয়াবহ শূন্যতা ও হতাশার মধ্যে দেশ আজ নিমজ্জিত, যার নজীর আমাদের নিকট-ইতিহাসে নেই।


নজীরবিহীন এই সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের একটি নতুন রাজনীতি (বা রাষ্ট্রনৈতিক কার্যক্রম), যে-রাজনীতি আমাদের সামনে উত্থাপন করবে ৩টি বিষয় : (এক) নতুন একটি রাষ্ট্রনৈতিক কর্মসূচী, (দুই) কর্মসূচী বাস্তবায়নের পথ ও পদ্ধতি-সম্বলিত একটি কর্মপরিকল্পনা এবং (তিন) ঘোষিত কর্মসূচী ও পথ-পদ্ধতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি সংগঠনের রূপকল্প।

এইসব দল বা সংগঠনের গঠনপ্রণালী বা কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কতিপয় মানুষ সম্মিলিত হয়ে প্রথমে একটি দল গঠন করে কর্মসূচী ঘোষণা করছে, এবং এরপর জনমানুষকে তাদের দলে যোগদান ও তাদের কর্মসূচী সমর্থনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। এভাবে গঠিত দলসমূহ প্রথম থেকেই নেতা আর কর্মীতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। নেতাদের পদ হয়ে যাচ্ছে স্থায়ী, সম্পত্তির মতো উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য। দল বা সংগঠনে কর্মী-অনুসরণকারীদের মালিকানা তো দূরের কথা, কখনো অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। কর্মীদের কাছে নেতাদের জবাবদিহিতার বদলে কর্মীরাই নেতাদের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকার রাজনৈতিক-সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এই ধরণের দল বা সংগঠন তাদের কাগজপত্রে যা-ই লিখুক বা মুখে যা-ই বলুক, যে-দলের অভ্যন্তরে কর্মী-সমর্থকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, সে-দলের দ্বারা কখনোই জনমানুষকে রাষ্ট্র-ক্ষমতার মালিক বানানো সম্ভব নয়। এমনকি তাদের পক্ষে জনমানুষকে রাষ্ট্রের মালিক বানানোর প্রকৃত রাজনীতিও করা সম্ভব নয়।