- হেলাল মহিউদ্দীন
কল্যাণ-রাষ্ট্র “এন্ড অব আইডিয়লজি” বা “আইডিয়লজির সমাধিক্ষেত্র” বলেই সুবিখ্যাত। ১৯৭৫ সালের পর হতে “কল্যাণ রাষ্ট্র” ও “এন্ড অব আইডিয়লজি” সমার্থক ধারণা হয়ে ওঠে। কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পর্কে যাঁদের অ-আ-ক-খ ধারণাটিও আছে, তাঁরাও এই পরিচিতিটি জানেন। এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত যে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র হতে হলে কোনো তত্ত্বাদর্শ লাগে না’।
হ্যারল্ড এল ঊইলেন্সকি কল্যাণ রাষ্ট্রের এই পরিচিতিটি দিলেন। তাঁর সাফ কথা— ‘নো রিলেশনশিপ বিট্যুইন আইডিয়লজি এন্ড ডেভেলপমেন্ট অব ওয়েলফেয়ার স্টেট’। এক-দুইটি নয়, ২২টি রাষ্ট্র [অর্থাৎ সবগুলো] সম্পর্কেই উইলেন্সকি এই মত দিলেন।
হ্যারল্ড এল উইলেন্সকি কল্যাণ রাষ্ট্র বিষয়ক সকল বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের গুরু। বিশ্ববিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কেলের ডাকসাঁইটে অধ্যাপক। চার দশকেরও অধিক সময় কল্যাণ রাষ্ট্র সংক্রান্ত বড় বড় গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করেছেন এবং মূল গবেষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর The Welfare State and Equality: Structural and Ideological Roots of Public Expenditure. কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর সমাজ, গণতন্ত্র, এবং সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রামাণ্য দলিল এই গবেষণা গ্রন্থটি। বইটিতে তিনি কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই জানান দেন যে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে তত্ত্বাদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই।
বইটি প্রকাশের পরপরই ন্যাশলান সায়েন্স ফাউন্ডেশনের বিখ্যাত ‘মোজাইক’ জার্নালে সারসংক্ষেপ প্রকাশ পায়। তাঁর মতে ‘কল্যাণ’ কী? আলোচনার শুরুর বাক্যেই সেই উত্তরটি আছে—
“incorporate a range of social policies including pensions, death benefits, and disability insurance; sickness and maternity benefits and a form of national health insurance or health services; and family or child allowance”.
আরো লেখা হয়েছে—
“Wilensky’s findings, however, suggest that rhetoric has little to do with broad strategies of insurance against the major risks of modern life”.
আধুনিক জীবনের বড় বড় ঝুঁকি মোকাবিলায় যেখানে ব্যাপক সুরক্ষা কৌশল লাগে, সেখানে “রেটরিক” বা তত্ত্বকথার বাগাড়ম্বরের কোনো ভূমিকা পালন করার মত কিছু নাই বললেই চলে।
‘রেটরিক’ বা তত্ত্বকথার বাগাড়ম্বরই বৃহত্তর গলদ। বিশেষত যে কোনো কল্যাণকামী রাষ্ট্রচিন্তায়। গণমূখী রাষ্ট্রব্যবস্থা তত্ত্বাদর্শপূর্ণ রেটরিকনির্ভর হবে না। এগুলোতে ‘সোস্যাল পলিসিজ’ বা ‘সামাজিক নীতিমালাসমষ্টি’ই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। পলিসির আগে থাকে ‘প্রিন্সিপলস’। ‘প্রিন্সিপলস’ এবং ‘পলিসি’ দুইটি ভিন্ন বিষয়। বাংলায় উভয়টিকেই ‘নীতি’ বলা ও লেখা বেঠিক। অর্থের বিভ্রান্তি কাটানো সহজ অবশ্য। ‘প্রিন্সিপলস’ মূলত ‘মূলমন্ত্র’। অন্যদিকে ‘পলিসি’ বলতে নীতিমালাগুলোকে বোঝায়।
কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রিন্সিপল বা মূলমন্ত্র ‘ইগালিটেরিয়ান স্টেট’ বা ‘সর্বজনীন-সাম্যরাষ্ট্র’। মূলমন্ত্র ভাঙলে পাই— ক) সকল নাগরিকের সমানাধিকার। খ) আইন, বিচার ও শাসন ব্যবস্থাদি কারো প্রতি কোনো কারণেই কোনো রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। গ) সকলের মৌলিক মানবাধিকারগুলো সুনিশ্চিত থাকবে। ঘ) আয় ও সম্পদ বন্টন-ব্যবস্থায় যে কোনো রকম বৈষম্যই দূর করা হবে। অর্থাৎ, প্রিন্সিপল দিয়ে রাষ্ট্রের ‘দর্শন’ পরিস্কার বোঝা যায়। রাষ্ট্রচরিত্র যে জনকল্যাণমূলক, সেই সত্যটিও স্পষ্ট বোঝা যায়। এটাকে ‘শ্রেয়নীতি’ বলা চলে। রাষ্ট্রের ‘উদ্দেশ্য’ও বলা যায়। কল্যাণ রাষ্ট্রের বেলায় ‘সর্বোত্তম মানবিক ভাবনা’ই মূলমন্ত্র। রাষ্ট্রটি কী রকম সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে ‘প্রিন্সিপল’-এ।
তাহলে ‘পলিসিজ’ বা ‘নীতিমালা’ কি? যেই যেই খাতের যে সমস্যাগুলোর বা দূর্বলতাগুলোর কারণে জনগণের মধ্যে বৈষম্য ও বিভাজন তৈরি হয়, সেইসব খাতের সমস্যাগুলো ও দূর্বলতাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করাই পলিসি। যেমন ‘ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার পলিসি’ বা ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা-নীতি’। এভাবে ‘ইউনিভার্সাল’ বা সর্বজনীন শিশুসেবা (চাইল্ডকেয়ার), বার্ধক্যসেবা (ওল্ড-কেয়ার), জীবিকাহীনকালীন সেবা (আন-এমপ্লয়মেন্ট কেয়ার) ইত্যাদি। অর্থাৎ, রাষ্ট্রটি কী করবে প্রশ্নের উত্তর মিলছে পলিসিতে। ইংরেজি ‘গোল’ বা লক্ষ্য, অর্থাৎ কী অর্জন করতে চায় রাষ্ট্রটি প্রশ্নের উত্তর মিলছে পলিসিতে।
এরপর আসে কর্মকৌশল বা ‘স্ট্রাটেজি’। কীভাবে, অর্থাৎ কোন পদ্ধতিতে পলিসি বাস্তবায়ন করা হবে প্রশ্নের উত্তর মিলছে ‘স্ট্রাটেজি’তে। কল্যাণ রাষ্ট্রের বেলায় যেমন ‘প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সিং’ একটি স্ট্রাটেজি। যিনি যত বেশি উপার্জন করবেন, তিনি তত বেশি আয়কর দিবেন। কারণ, এই পদ্ধতিতে যাঁরা স্বল্প আয়জনিত সমস্যায় আছেন, রাষ্ট্র তাঁদের সমস্যামুক্ত রাখে। ফলে তাঁরা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকেন। সুস্থ দেহে সুস্থ মনে তাঁরাই আবার সক্ষম কর্মশক্তি হিসেবে সমাজে এবং অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন। [আরো জানতে আগ্রহি পাঠক Esra Dundar Aravacik এর Social Policy and the Welfare State বইটি পাঠ করতে পারেন।]
এই বিষয়গুলোকে কি সমাজতন্ত্রী বা সাম্যবাদী পদ্ধতির প্রয়োগ বলা যায়?
না! ঊইলেন্সকি জানাচ্ছেন, না! উইলেন্সকির ‘না’ বলার পেছনের কারণগুলো কিন্তু যথেষ্ট সহজবোধ্য। কল্যাণ রাষ্ট্র সমাজবাদী রাষ্ট্র নয়। কল্যাণ রাষ্ট্রের অর্থনীতিও পুঁজিতান্ত্রিক বা ক্যাপিটালিস্ট। এটি সমাজবাদী তত্ত্বাদর্শের বাস্তবায়নে ইচ্ছুকও নয়। সমাজপরিবর্তনে বিপ্লবকেও অপরিহার্য মনে করে না। ‘প্রলিতারিয়েতের একনায়কত্ব’ ধারণাটিকেও বাস্তবানুগ বিবেচনা করে না। ‘খোলা বাজার অর্থনীতি’ কল্যাণ রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিময়ের নীতিমালা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তবুও এই ব্যবস্থাটিই ‘ইগালিট্যারিয়্যান’ বা সমানাধিকার-নির্ভর। ইগালিট্যারিয়্যান আচরণ জন রঔলস-এর ভাষায় ‘ইতিবাচক কর্মযজ্ঞ’ বা ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’।
‘ওপেন মার্কেট ইকোনমি’ সমাজবাদ্ বা সোস্যালিজমের বিরোধী দর্শন। কৌমবাদ (সাম্যবাদ) বা কমিউনিজম-এর দর্শনেরও বিরোধী। পুঁজিবাদও একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি মাত্র, তত্ত্বাদর্শ নয়। ‘খোলাবাজার’ একটি মন্ত্র বা প্রিন্সিপল মাত্র। পুঁজিবাদী দেশগুলো এটিকে একসময় নীতিমালা বানিয়ে ফেলে। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো এই মূলমন্ত্র এবং নীতিমালাকে গ্রহণ করতে পিছপাও হয় না। কারণ, তার তত্ত্বাদর্শ-নির্ভরতার কোনোই গরজ বালাই নেই। সমাজবাদী তত্ত্বনির্ভর হলে এই পুঁজিবাদী আচরণ সাংঘর্ষিক প্রিন্সিপল-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতো। ভারি শিল্পায়ন কল্যাণ রাষ্ট্র দ্বারা বিশেষভাবে সমর্থিত। এটিও সমাজবাদী অর্থনৈতিক নৈতিকতাবিরোধী ও পদ্ধতিবিরোধী। সমাজবাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির ও ব্যক্তি-মালিকানার উচ্ছেদ। কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ চায় না।
এইসব বিষয়ে অন্তত আরো দুইটি বই উল্লেখ্য। একটি রিচার্ড কফ্লিন এর ১৯৮০ সালে প্রকাশিত Ideology, Public Opinion and Welfare Policy: Attitudes Towards Taxes and Spending in Industrialised Countries এবং অন্যটি ভিক জর্জ এবং পল উইল্ডিং-এর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত Welfare and Ideology.
অর্থাৎ কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো ‘প্রিন্সিপল’, ‘পলিসি’ এবং ‘স্ট্রাটেজি’র জোরে ‘ইগালিটেরিয়ান স্টেট’ হয়েছে। ‘আইডিয়লজি’র প্রভাবে হয়নি। কেউ কেউ তর্ক করেন ‘ইগালিটেরিয়ান স্টেট’ও এক ধরণের আদর্শ। এই তর্কটি অজ্ঞতাপ্রসূত, এবং অনর্থক তর্কের খাতিরে তর্ক করা ছাড়া কিছুই নয়। কল্যাণ রাষ্ট্র বিষয়ক সকল পাঠেই ‘ইগালিটেরিয়ান স্টেট’, ‘ইগালিটেরিয়ান প্রিন্সিপল’ এবং ‘ইগালিটেরিয়ান পলিসি’ উল্লেখ করা আছে। ‘ইগালিটেরিয়ান আইডিয়লজি’ কেউ ব্যবহার করে থাকলে অজ্ঞানতাবশত করে থাকেন।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ এক ধরণের ‘আইডিয়লজি’—এমনটি মনে করা রাষ্ট্রভাবনার তীব্রতর গলদগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশে এই গলদ অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। মোটা দাগে বাংলাদেশের প্রগতিশীল দাবীদারদের মধ্যে এই সমস্যাটি মহামারি আকারে বিস্তৃত। তাঁরা নিশ্চিত নন কী ধরণের রাষ্ট্র চান। এ জন্য তত্ত্ববাগীশরাও নিজেদের মধ্যে অসংখ্য উপদলে বিভক্ত। তাঁদের রাজনৈতিক জনসম্পৃক্ততা নিতান্তই নগন্য। সাধারণ জনগণ তাঁদের তত্ত্ববাগীশতায় অর্থপূর্ণ কিছু যেমন পায় না, চিন্তার সংযোগ বা আশাবাদী হবার মত কিছুও দেখে না। ফলে জনগণের শেষ ভরসা লোকরঞ্জনবাদী দূর্বৃত্ত রাজনৈতিক দলগুলোই। প্রগতিশীল দাবীদাররা ছকবদ্ধ চিন্তার বাইরে কদাচিত নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানান। সহযোদ্ধাদেরও চিন্তার নুন হতে চুন খসলে তাঁরা তাঁদের রেটরিকের ভান্ডার উজাড় করে আক্রমণ করে বসেন। ‘সংশোধনবাদী’, ‘সংস্কারপন্থী’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, ‘প্রতিবিপ্লবী’, ‘অন্তর্ঘাতি’, ‘অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা’ ইত্যাদি রেটরিক যাচ্ছে-তাই ও যত্রতত্র পারম্পর্যহীন প্রয়োগ করতে তাদের বাধে না। এ রকম কূপমন্ডুকতা রাষ্ট্রভাবনার তীব্রতর গলদ এই কারণে যে তাঁরা যে কোনো রাষ্ট্রসংস্কারের পথে সহায়ক না হয়ে তীব্র বাধারূপে আবির্ভূত হন।
উইলেন্সকি রাষ্ট্রভাবনার তীব্রতর গলদগুলো ইউরোপের সমাজবাদী ঘরাণায়ও খেয়াল করেছিলেন। সেজন্যই তিনি অপ্রয়োজনীয় এবং অকার্যকর রেটরিক ও তত্ত্বাদর্শের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
অনেকেই উইলেন্সকির মত খণ্ডন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অনেকগুলো সমালোচনামূলক লেখার শুরুই হয়েছে তাঁর তত্ত্বাদর্শ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়ে। নীচের উদাহরণটির মত। যার শুরুই হয়েছে—“In The Welfare State and Equality (1975), Harold L. Wilensky found no relationship between ideology and the development of welfare state”. কিন্তু উইলেন্সকির সমালোচনাগুলোর কোনোটিই হালে পানি পায়নি। এখনো বিশ্বময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পর্কে দেওয়া প্রথম পাঠেই উইলেন্সকির অভিজ্ঞানটির উল্লেখ করা হয় যে তত্ত্বাদর্শ ছাড়াই সবচাইতে সফল ও কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার নাম কল্যাণ রাষ্ট্র। সতর্ক করা হয় যাতে কেউ কল্যাণ রাষ্ট্রের মধ্যে তত্ত্বাদর্শ খুঁজতে না যান।
‘আইডিয়লজি’কে কিন্তু মোটেই নিন্দামন্দ করা হচ্ছে না। বরং, প্রথম এবং দ্বিতীয় কিস্তির লেখাতেই বলা হয়েছে যে ‘আইডিয়লজি’ ছাড়া জ্ঞানজাগতিক বিকাশ অসম্ভব। ধর্মকে যেমন রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া মহাবিপজ্জনক, আইডিয়লজি-নির্ভরতাও সমান বিপজ্জনক। কারণ, ধর্মগুলোও কোনো না কোনো মাত্রায় আইডিয়লজিই। অনুসারীদের একরৈখিক নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কারণে আইডিয়লজিও কোনো না কোনো সময় এক রকম ধর্ম-ধর্ম রূপ ধারণ করে। অনেক সময় আইডিয়লজির শরীরে এক ধরণের একগুঁয়েমি থাকে। ‘আমিই ঠিক’ ধরণের মৌলবাদী আত্মম্ভরিতা থাকে। তবু জ্ঞানজাগতিক তর্ক-বিতর্ক বেগবান করাই শুধু নয়, আইডিয়লজির ভিতর হতে মানবিক ভাবনাগুলো তুলে এনে রাষ্ট্রকে আরো জনকল্যাণমূখী করার চেষ্টা চলতে পারে।
এই প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতে লিখেছিলাম—‘আইডিয়লজি চিন্তার কাঠামো বা ধরণ যেগুলোর মাধ্যমে অর্থনীতি বা রাজনীতি-সম্পর্কিত তত্ত্ব বা নতুন নতুন ভাবনা দাঁড় করানো যেতে পারে। রাষ্ট্রচিন্তায় শুদ্ধি আনা যেতে পারে। প্রিন্সিপলসগুলোকে আরো ঘষে-মেজে নেয়া যেতে পারে ইত্যাদি।’
দ্বিতীয় কিস্তিতে লিখেছিলাম—‘সমাজবাদী জ্ঞানকাণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী বিধায় পুঁজিবাদের মানিবিকীকরণে সমাজবাদী আদর্শিকতা দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই। কিন্তু এসব রাষ্ট্র সামাজিক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদে রূপ নিয়েছে। এই মানবিকীকৃত পুঁজিবাদের প্রতি নাগরিকদের ভালবাসা, অনুরক্তি, সম্মান, সমর্থন সবই আছে’।
কল্যাণ রাষ্ট্রের চরিত্র বা আইডিয়লজি ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’— সাধারণ্যে প্রচলিত এই ধারণা আরো তীব্রতর এক গলদ। ‘সোস্যাল ডেমক্রেসি’ আসলে দর্শন বা ফিলসফি। এটি কেইন্সিয়ান অর্থনীতির উদারপন্থি সামাজিক অভিযোজন, মার্ক্সীয় সমাজবাদ হতে সরে যেতে যেতে যা উদারবাদী-পুঁজিবাদী সামাজিক কল্যাণ ব্যাবস্থাপনার দিকে চলে গেছে। নর্ডিক মডেল, সামাজিক উদারতা, কল্যাণ রাষ্ট্র সবগুলো ধারণাই কেইনিসিয় সমাজ-অর্থনীতির ভাবনাসঞ্জাত। আইডিয়লজি নয় বলেই কল্যাণ রাষ্ট্র ধারণা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েনি। আইডিয়লজি একটি বৈশ্বিক বিষয়। আইডিয়লজি হলে ইওরোপ ও উত্তর আমেরিকার কিছু পকেটে যুগের পর যুগ সীমাবদ্ধ না থেকে দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়ত।
‘সোস্যাল ডেমক্রেসি’কে আইডিয়লজি ভাবা কেন তীব্রতর একটি গলদ? নাজি হিটলার ও নাৎসি মুসোলিনির উগ্র বর্ণবাদী ও ধ্বংসকামী রাজনৈতিক দর্শনের নাম ছিল ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি’। তাদের দলের নাম ছিল ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’। দলের উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্র বিস্তারের সকল সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে দেওয়া, সমাজতন্ত্রকে বুকে টেনে নেওয়া নয়।
কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর নীতিমালাগুলোতে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’ একটি ‘প্রিন্সিপল’, অর্থাৎ মূলমন্ত্র, আইডিয়লজি নয়। কিছু কিছু লেখায় আইডিয়লজি দেখা গেলেও সেইসব লেখা ভুল।
এ কথা সত্য যে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’ আইডিয়লজি হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু সেই আইডিয়লজি ছিল সমাজতন্ত্রীদের দ্বারাই সমাজতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আইডিয়লজি। ১৮৬৯ হতে ১৮৭৫ সাল সময়ে অগাস্ট বেবেল ও ভিলহেম লীবনেখট জানালেন যে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রে বলা ‘শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব’, ‘পুঁজিবাদী নিষ্ঠুরতা’ ইত্যাদি ধারণা যুগোপযোগী নয়। তারা জানালেন বিপ্লব দরকার নাই, শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রচলিত আইন অমান্য না করেই পুঁজিবাদ হতে সমাজতন্ত্রে যাওয়া যাবে। সে জন্য শ্রমিকদের সংগঠন এক করে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মানি’ তৈরি করলেন।
মার্ক্সবাদীরা তাঁদের ‘রিভিশানিস্ট’ বা ‘সংশোধনবাদী’ তকমা দিয়ে দারুণ বিরোধিতা করে গিয়েছেন। কয়েক বছর পর এই দলে যুক্ত হলেন সমাজতন্ত্রী তাত্ত্বিক এডোয়ার্ড বার্ণস্টিন। তিনি তো ‘অর্থোডক্স মার্ক্সিজম’ বলে ধ্রুপদি মার্ক্সিস্টদের কঠোর সমালোচনাই করেছেন। ‘পুঁজিবাদ পতনের দিকে যাবে ও যাচ্ছে’—এই মার্কসীয় বয়ানকে চ্যালেঞ্জও করলেন। জানালেন— পুঁজিবাদ খুব দ্রুতই তার সমস্যা ও দূর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠছে। এইসব ডামাডোলে প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’ ধারণা নাজি-নাৎসি-ফ্যসিবাদীদের উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্যই সিদ্ধি করেছিল।
তবুও রাষ্ট্রভাবনায় বেবেল-লিবনেখট-বার্ণস্টিন এর কিছুটা প্রভাব টিকে রইল। তাদের ধারণাগুলোর ছায়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে জন্ম নিল ‘লিবার্যাল ডেমোক্রেসি’, ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’ নয়। ব্রিটেনে যেমন শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল ‘লিব্যার্যাল পার্টি’। কানাডা-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যাদের ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাট’ বলা হয়, তারা আসলে লিব্যার্যাল দল। তাদের পরিচিতি সেন্টার-লেফট বা কেন্দ্র-বাম ধারার রাজনীতি চর্চ্চাকারী হিসেবে। এইসব কোনো দলই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত নিয়ে, বা রাষ্ট্রচরিত্র বদলের জন্য রাজনীতি করে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা প্রয়োগের মাধ্যমে জনকল্যাণধর্মী রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাট’ একটি লেবেল মাত্র। এইটি দ্বারা রাজনীতিক কোন তাঁবুর সেটি বুঝা যায়। টোরি-লিব্যার্যাল, কনজার্ভেটিভ-লিব্যার্যাল-এর যে ‘লিব্যার্যাল’ সেটিই ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাট’ শব্দদ্বয়ের চাইতে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু কেন? কারণ, ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাট’ আসলেই একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ বিভ্রান্তিকর প্রত্যয়। তার চাইতে ‘লিব্যার্যাল’ অনেক স্পষ্ট ধারণা।
কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো স্বর্গ নয়। এগুলোরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। শ্রেণি বিভাজন আছে। নিত্যনতুন সমস্যা আছে। কিন্তু সমস্যা সহনীয় রাখার যাবতীয় চেষ্টাই থাকে বলে শ্রেণিও ‘প্যারেটো অপ্টিমাম’ নীতি দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত। এই নীতি অনুযায়ী বৈষম্য ও অসাম্য ততটুকু পর্যন্ত জায়েজ যতটুকু পর্যন্ত অন্য কারো ক্ষতির কারণ না হয় (inequalities are acceptable until someone is hurt). জন রঔলস এর বিখ্যাত তত্ত্ব ‘জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস’ বা ‘সুবিচার আসলে স্বচ্ছতা (সুশাসন)। স্ক্যান্ডিনেভিয় কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো এবং কানাডা ও নিউজিল্যান্ড রাষ্ট্রপরিচালনা-নীতিতে তত্ত্বটিকে দারুণভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছে। তবু তিনি কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর সমালোচনা করে থাকেন। তাঁর বক্তব্য, সেখানে ‘আন্ডারক্লাস’ একটি শ্রেণি যারা কল্যাণমূলক খয়রাতি সেবার ওপর নির্ভরশীল, অনুৎপাদনশীল, এবং পরজীবীতে পরিণত হচ্ছে। তিনি চিন্তায় সমাজবাদী। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদের বিরোধী তো ননই, বরং বাড়ানোর পক্ষে। যাতে পরিজীবী শ্রেণিটি, যেটি রাষ্ট্রনির্ভর তারাও ব্যক্তিগত সম্পদের মালিক হতে পারে। তিনি ওয়েলফেয়ার স্টেট ক্যাপিটালিজম (WSC)এর বিকল্প প্রস্তাব করেন। বিকল্পটির নাম ‘প্রপার্টি-ঔনিং ডেমোক্রেসি’ (POD)।
ভিক জর্জ এবং পল উইল্ডিং Welfare and Ideology বইতে দেখালেন যে, মুলত ছয়টি তত্ত্বাদর্শের আলোকে কল্যাণ রাষ্ট্রকে বোঝা যাবে। বর্তমান সময়ে এই ছয়টি তত্ত্বাদর্শই কল্যাণ রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। অনাগত ভবিষ্যতেও এগুলোর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা বহাল থাকবে। কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্র কোনোটির কবলে না পড়েই নিজের স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষত্ব রক্ষা করতে পারবার মত নিজস্ব শক্তি অর্জন করে ফেলেছে। এই ছয়টি তত্ত্বাদর্শ হচ্ছে ১) নব্য ডানপন্থা (নিও-রাইট), ২) মধ্যপন্থা (মিডল ওয়্যে), ৩) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজম), ৪) মার্কসবাদ, ৫) নারীবাদ এবং ৬) সবুজদুনিয়াবাদ (গ্রীনিজম)।
ভিক জর্জ এবং পল উইল্ডিং তাদের খেটেখুটে করা রাষ্ট্রভাবনাতেও ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’কে আমলেই নেননি। আইডিয়লজির তালিকায়ও কি এনেছেন? ঊঁহু, আনেননি। আনার কোনো কারণ নেই বলেই আনেননি। ছয়টি বাস্তব তত্ত্বাদর্শের কোথাও উল্লেখ নেই কারণ ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি’ আইডিয়লজি নয়। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির রেটরিকতাড়িতরা তাঁদের রাষ্ট্রভাবনায় এইসব তীব্রতর গলদ যত দ্রুত অনুধাবন করতে পারবেন, ততই দ্রুততার সঙ্গে একটি কাম্য রাষ্ট্র বিষয়ে চিন্তার ঐক্য তৈরি হবে।
গত বছরের শেষদিকে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী জানান দিয়েছেন যে, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বেশ আশা জাগানিয়া খবর নিঃসন্দেহে। কিন্তু কোন শর্তে আমরা কল্যাণ রাষ্ট্র পাব, বিষয়টি মোটেই স্পষ্ট নয়। আশা করা যায় তাঁরা আসলেই স্বচ্ছতার সঙ্গে একটি আগামীর রাষ্ট্রভাবনায় যুক্ত হবেন।
- হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান; এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম কিস্তি: রাষ্ট্রসত্তায় দুইটি মহাগলদ
দ্বিতীয় কিস্তি: রাষ্ট্র-ভাবনায় তীব্রতম গলদ