- মোহাম্মদ আজম
আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে রণজিৎ গুহের (১৯২৩-২০২৩) বয়স একশ বছর হত। দুনিয়াজুড়ে মানুষের গড় আয়ু ঢের বাড়লেও এখনো একশ বছরে পদার্পণ করে মৃত্যুবরণ করা যথেষ্ট ঈর্ষণীয় ব্যাপার। তবে রণজিতের শতায়ু হওয়ার একটা বিশেষত্ব আছে। অধিকাংশ কৃতী মানুষ সাধারণত পঞ্চাশ-ষাটেই নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে ফেলেন; আর সাধারণভাবে আশি-নব্বইয়ের পর নতুন কোনো সৃষ্টিশীলতায় যেতে পারেন না। রণজিৎ গুহ এদিক থেকে বিরল ব্যতিক্রম। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রায় সবই তিনি করেছেন নিয়মিত শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ার পরে। আর নিতান্ত প্রবীণ বয়সে বাংলায় নতুনভাবে লেখা শুরু করে দ্রুত লিখে ফেলেছেন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কেতাব। এদিক থেকে তিনি খুব বিরলপ্রজদেরই একজন। দীর্ঘ হায়াত পাওয়া আর সুস্থ থাকা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু দীর্ঘ জীবন ধরে সৃষ্টিশীল থাকাকে ঠিক ভাগ্যের কোটায় ফেলা যায় না। যে প্রাণশক্তি ও কৌতূহল নিয়ে নিজের চারপাশকে আর এ মানব-জন্মকে জানতে-বুঝতে চেয়েছেন, তার গভীরতা ও প্রস্তুতির বিস্তার দিয়েই রণজিৎ গুহের তত্ত্বীয়-প্রায়োগিক অ্যাডভেঞ্চারকে ব্যাখ্যা করতে হবে। সেটাই হতে পারে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর একটা উপায়।
রণজিৎ গুহের প্রজন্মের বিদ্যাজীবীদের কেউ কেউ, এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই ‘ক্রিটিকেল থিংকিং’য়ের জন্য খ্যাতি পেয়েছেন। একে বাংলায় বলতে পারি ‘পর্যালোচনামূলক ভাবনা-চিন্তা’। মূলত আধুনিক ও লিবারেল জমানার দীর্ঘ ছায়ায় বিকশিত ধ্যান-ধারণার সমালোচনা ও পর্যালোচনা এঁদের কাজের মূল বৈশিষ্ট্য। বিশ শতকের ষাটের দশকে এ ধরনের কাজের তাত্ত্বিক-প্রায়োগিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল দুনিয়ার অগ্রসর ভাবুক-সমাজে। নয়া-মার্কসবাদীরা উপরি-কাঠামোকে গভীরতর গুরুত্ব দিয়ে জীবন ও জগৎ ব্যাখ্যা করার নানা জুতসই কলা রপ্ত করেছিলেন। কাঠামোবাদী চিন্তা তার স্বর্ণযুগ পার করছিল সময়টাতে। নারীবাদী আর উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনা ওই দশক এবং পরের দশকে পূর্বতন জ্ঞানের প্রায় সবটাকেই নতুন করে দেখতে-বুঝতে বাধ্য করছিল। তাঁদের সহায় হয়েছিল ভাষা-দর্শন আর চিহ্নবিদ্যার দারুণ সব কৃৎকৌশল। আমাদের অঞ্চলে এসব চিন্তা-ভাবনা সাধারণত একটু দেরিতে এসে পৌঁছায়। কিন্তু লক্ষণবিচারে মনে হয়, রণজিৎ গুহ এ ধরনের র্যাডিকেল ও ক্রিটিকেল চিন্তা-ভাবনা রপ্ত করেছিলেন দুনিয়ার অন্য এলাকার বিদ্যাজীবীদের সমকালেই।
জীবনের বড় অংশই তিনি কাটিয়েছিলেন দেশের বাইরে। কিন্তু কাজটা ছিল তাঁর দেশেই। অনেক বিশ্লেষক অনুমান করেছেন, বিদেশে থাকাটা তাঁর জন্য ভালোই হয়েছিল। হয়ত ভিন্ন ধরনের একাডেমি তাঁকে আলাদা করে ভাবার অপার সুযোগ দিয়েছিল। হয়ত দূর থেকে তাঁর ‘ইতিহাসে’ অবস্থান খোদ ইতিহাসটাকে গভীরভাবে দেখার অবকাশ দিয়েছিল। তিনি ইতিহাসেই ছিলেন। শাস্ত্রীয় চর্চা আর তার ধারাবাহিকতার মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু তখন নতুন ভাবনা-চিন্তার জোয়ারে শাস্ত্র-নির্দিষ্ট জ্ঞানকাণ্ডে অনেকেই ইমান রাখতে পারছিলেন না। তখন তত্ত্বের জোয়ারে খোদ ডিসিপ্লিনের বেড়াগুলো ভীষণ আলগা হয়ে গিয়ে শাস্ত্রগুলোর একটিকে আরেকটির সাথে জুড়ে দিচ্ছিল। রণজিৎ গুহ এ জ্ঞানতাত্ত্বিক আবহের মধ্যে ফিরে ফিরে দেখছিলেন তাঁর ভারতবর্ষকে। এ কারণেই তাঁর নাম যুক্ত হয়ে গেছে বহু ডিসিপ্লিনের সাথে। দক্ষিণ এশীয় আবহের গভীরে ঢুকেই তিনি দুনিয়ার জ্ঞানভান্ডারে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। নতুন সব প্রশ্ন ছিল সমাগত। উত্তর অজানা। কিন্তু নতুন জ্ঞানতত্ত্বে আসলে নির্দিষ্ট কোনো উত্তরের বাসনাই প্রধানভাবে ছিল না। বিদ্যমান জ্ঞানকাণ্ডের সমালোচনা আর পর্যালোচনাই প্রশ্নকে উত্তরের আকার দিচ্ছিল। রণজিৎ গুহের কাজকর্মকে এদিক থেকে সামগ্রিক অর্থে বলতে পারি ‘সমালোচনা’।
তবে তাঁর ক্ষেত্রে শব্দটির আরো বিশেষ এবং একরৈখিক অর্থও ছিল। ‘সমালোচনা’ শব্দটি আমরা বিশেষভাবে ব্যবহার করি সাহিত্যের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে। রণজিতের প্রবন্ধাবলির এক সম্পাদক মশহুর তাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, জীবনের শেষ পর্বে তিনি বিশেষভাবে এ উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে, সাহিত্যই মানুষের জীবনকে তার স্বরূপে উপস্থাপনের জন্য সবচেয়ে ভালো কলা। যদি মনে রাখি, সামষ্টিক কাঠামোর মধ্যে ক্রিয়ারত ব্যক্তিমানুষকে তার অন্তর্লোক আর বহিঃসম্পর্কের সামগ্রিকতায় ধারণ করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের কোনো জুড়ি নাই, তাহলে সাহিত্যের প্রতি রণজিৎ গুহের এ পক্ষপাতের কারণ উপলব্ধি করা খুব কঠিন হবে না। তাতে জীবনের শেষ যুগে সাহিত্য-সমালোচনায় তাঁর অসামান্য সাফল্যে আমাদের বিস্ময়বোধও হয়ত খানিকটা কমবে। তবে সাহিত্য-সমালোচনা যে তিনি কেবল শেষ জীবনে করেছেন এবং বাংলা ভাষায় করেছেন তা নয়। ইংরেজিতে লেখা অনেক আগের সমালোচনামূলক লেখাও আছে। কাজেই রণজিৎ গুহকে সাহিত্যিক অর্থেও সমালোচক বলা সম্ভব, আর তাঁর রচনাকে সমালোচনা।
এ লেখায় আমরা দুটি রচনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রণজিৎ গুহের ‘সমালোচনা’র স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করব।
‘অ্যান ইন্ডিয়ান হিস্টোরিওগ্রাফি অব ইন্ডিয়া: অ্যা নাইন্টিনথ-সেঞ্চুরি এজেন্ডা অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশন’ বেরিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। বইটি কলকাতায় দেয়া তিনটি বক্তৃতার সংকলন। রণজিতের বর্ণাঢ্য লেখক-জীবনের খুব উল্লেখযোগ্য বই না হলেও ইতিহাসতাত্ত্বিক হিসাবে তাঁর প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে তা খুব নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করে। বইয়ের প্রথমেই তিনি ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসের সূচনা-বছর হিসাবে শনাক্ত করেন ১৭৬৫ সালকে। উনিশ শতকে ব্রিটিশরা যখন গুছিয়ে বসেছিল, আর জন্ম দিয়েছিল খুব গোছানো এক অনুগত ভদ্রলোক শ্রেণির – আমাদের প্রভাবশালী ইতিহাসে সাধারণত তখন থেকেই আলোচনার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে রেনেসাঁস বা আলোকায়নের গল্পটি জমে ভালো। রণজিৎ গুহ ব্রিটিশ শাসনের মূল ভিত্তিগুলো পড়তে চান আরো আগে থেকে, যাতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসকে উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়া হিসাবে পড়তে সুবিধা হয়। তিনি লক্ষ করেছেন, আমাদের ইতিহাস সাধারণভাবে উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়াকে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না; কারণ, এ ইতিহাস প্রধানত লিখেছেন তারাই যাদের জন্ম ওই প্রক্রিয়ার মধ্যেই।
তাঁর মতে, ব্রিটিশদের প্রাচ্যবিদ্যার চর্চা আসলে শাসকপক্ষের অপূর্ণতা, এবং তার পূর্ণকরণ প্রকল্প, অন্যদিকে স্থানীয়দের জন্য আয়োজিত শিক্ষা-কার্যক্রমকে আধুনিকতা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদি যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা-সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত। যারা ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখেছেন, তারা শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকে ক্ষমতা-সম্পর্কের সাথে এতটাই একাকার যে, ভারতবর্ষের নিজস্ব ইতিহাসের এজেন্ডা তাতে থাকার প্রশ্নই আসে না। উনিশ শতকের গোড়ায় রামরাম বসু, রাজিবলোচন মুখোপাধ্যায় কিংবা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার পুরনো বিশ্বাস ও ভাষা-কাঠামোয় ইতিহাস লিখেছেন। কিন্তু শীঘ্রই এ ভাষা ও ইতিহাসদৃষ্টি পরিবর্তিত হয়ে যায়। জেমস মিল ও জে. সি. মার্শম্যানের মতো ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের ছাঁচই আদর্শ বলে গণ্য হতে থাকে। এর মধ্যেই রজনীকান্ত গুপ্ত ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ (১৮৮০) লিখেছেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন ‘সিরাজুদ্দৌলা’ (১৮৯৮)। দুটিই, রণজিতের মতে, প্রশংসনীয় কাজ হলেও তথ্য-উপাত্তের দিক থেকে ব্যাপকভাবে ব্রিটিশ উৎসের উপর নির্ভরশীল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮০ নাগাদ কয়েকটি প্রবন্ধে নিজস্ব ইতিহাসের আবেদন জানান। কিন্তু তাঁর উদ্যোগে একদিকে কলোনিয়াল বিশ্বদৃষ্টির প্রবল প্রতাপ, অন্যদিকে উপনিবেশ-পূর্ব ভারত বিষয়ে কলোনিয়াল জ্ঞানের প্রভাবেই ‘অপর’ নির্ধারণে তাঁর বিরাট গোলমাল। কাজেই উনিশ শতক জুড়ে ভারতীয় মূলধারার ইতিহাস আদতে ভারতীয় ‘এজেন্ডা’র সাক্ষাৎই পায়নি।
বইটিতে রণজিৎ গুহের প্রধান দাবিকে এভাবে প্রকাশ করা যায়: যাকে বলে ‘ক্রিটিক অব কলোনিয়াল পাওয়ার’, ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসচর্চায় তা সর্বত্রই অনুপস্থিত। কলোনিয়াল-পোস্টকলোনিয়াল ইতিহাসের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক যে ক্ষমতা-সম্পর্ক বিষয়ে নিগূঢ়ভাবে সচেতন হবেন, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু এখানে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘ক্রিটিক’ শব্দটি। বলা যায়, রণজিৎ গুহ কাজটি করেছেন, এবং এ অর্থে ‘সমালোচনা’ রণজিৎ গুহের অন্যতম প্রধান চাবিশব্দ।
দ্বিতীয় রচনা ‘নীল দর্পণ: দি ইমেজ অব অ্যা পিজেন্ট রিভোল্ট ইন অ্যা লিবারেল মিরর’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। উপনিবেশিত ভারতে আধিপত্য আর অধীনতার যে ব্যাকরণ গুহ বহুদিন ধরে খুঁজেছেন, এ লেখায় তার চমৎকার সূত্রপাত। প্রথমেই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এ নাটকের এরকম প্রবাদপ্রতিম খ্যাতির কারণ কী? এর সাথে মধুসূদন দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র এবং এরকম আরো বহুজনের নাম এত গভীরভাবে জড়ালো কেন? গুহের উত্তর খুবই ‘ক্রিটিকেল’: এটা ছিল নাগরিক লিবারেলদের মুখ বাঁচানোর প্রকল্প। ঘোরতর কলোনিয়াল শাসনে নানা ধরনের অধীনতার মধ্যে যে জীবন তারা যাপন করছিল, নীল-দর্পণের ছদ্ম-বিদ্রোহ তাতে একটা ইজ্জত-রক্ষাকারী আবরু তৈরি করে। কিন্তু আদতে এ নাটক মোটেই কলোনিয়াল শাসনের বিরোধিতা নয়।
রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, ‘নীল-দর্পণ’ নাটকের লেখক ও পাত্র-পাত্রী এবং এর প্রশংসাকারীরা উপনিবেশিত জনসমাজে সঞ্চারিত ‘উদারনৈতিক মানবতাবাদী’ ঘরানার। ইংরেজি শিক্ষা-বাহিত এ দৃষ্টিভঙ্গি নবীনমাধবের উচ্চারণে খুব স্পষ্ট; আর বিন্দুমাধব তো রীতিমতো পাশ-করা ভদ্রলোক। বিপরীতে নীলচাষীদের একাংশ উদারনীতি ও শিক্ষার বিরোধী। বে-ইনসাফির জন্য এরাই দায়ী, সরকার নয়। কারণ সরকারি আইনে এ নিপীড়নের রক্ষাকবচ আছে। পুরো উনিশ শতক জুড়ে বাঙালি ভদ্রলোক-সমাজের সরকারের কাছে অন্যতম প্রধান ফরিয়াদ ছিল, এ আইনের সুরক্ষা যেন তারা পায়। নবীনমাধব ও তার পরিবার স্পষ্টতই আইন মেনে চলে, আইনের উপর ভরসাও রাখে। পক্ষান্তরে উডসহ নীলচাষীদের একাংশ আইন-বিরোধী। বস্তুত এটাই কলোনিয়াল ভারতের বিখ্যাত ‘ছোট ইংরেজ-বড় ইংরেজ’ তত্ত্ব। এর মধ্য দিয়ে কলোনিয়াল নিপীড়নকে ‘ছোটা ইংরেজে’র জিম্মায় দিয়ে ভদ্রলোক-সমাজ কল্পিত ‘বড় ইংরেজে’র সোহবতে মশগুল থাকতে পেরেছে।
মুশকিল হল, রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, এ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রচার অল্প কিছু ভুল-ত্রুটিসহ ঔপনিবেশিক শাসনকে রেয়াত দেয়। লেখক ও চরিত্রগুলোর দৃষ্টিতে নীলচাষিদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘৃণার বিপরীতে জমা হয় রাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। গুহের মতে, তা-ই স্বাভাবিক। কারণ, এর লেখক দীনবন্ধু মিত্র নিজেই, এবং সমকালীন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, এ দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ পোষক। দীনবন্ধুর অন্য লেখাপত্রও পরিষ্কার সাক্ষ্য দেয়, তিনি ব্রিটিশ শাসনের অনুগতই শুধু নন, মনে করেন, এ শাসনেই ভারতের কল্যাণ নিহিত। মুসলমানরা বিদেশি, আর ওই বিদেশি দুরাচারদের হাত থেকে ব্রিটিশরাই ভারতকে বাঁচিয়েছে – এ জ্ঞানেও তাঁর ইমান খুবই পাকা। গুহ লিখেছেন, এ ধরনের ‘কম্যুনাল’, ‘প্যারোকিয়াল’ ও ‘লয়ালিস্ট’ লেখক যে আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ হয়ে উঠল, তা ওই জাতীয়তাবাদকেই চিনিয়ে দেয়। আদতে এটা এক গভীর-ব্যাপক রাজনুগত্যের নাটক, যা পেটি-বুর্জোয়া বিপ্লবপনার মেনিফেস্টো হয়ে উঠেছে।
কিন্তু রণজিৎ গুহের প্রশ্নটি আসলে এরচেয়েও গভীর। ভদ্রলোক-সমাজ তার নিজের চিত্রায়ণ যেভাবে ইচ্ছা করুক, কিন্তু তাদের এরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে অঙ্কিত কৃষকসহ অন্য নিম্নবর্গের মানুষ যদি হয়ে ওঠে নিম্নবর্গের প্রতিনিধি, তাহলে তার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি তো বিপুল। বাংলা সাহিত্যে ‘নীল-দর্পণে’র তোরাপের পরিচিতি কৃষক-সমাজের এক তুরীয় প্রতিনিধি হিসাবে। কিন্তু রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, তোরাপ তার ভাষা, উচ্চারণ, ভঙ্গি সব অর্থেই এক ভদ্রলোকি নির্মাণ। ‘তোরাপ ইজ অ্যা স্যুডো পিজেন্ট অ্যান্ড স্যুডো র্যাবেল’।
‘নীল দর্পণ: দি ইমেজ অব অ্যা পিজেন্ট রিভোল্ট ইন অ্যা লিবারেল মিরর’ সাহিত্য-সমালোচনার এক তুখোড় দৃষ্টান্ত। মামলার বিবরণ, সংবাদপত্রের সাক্ষ্য এবং অন্যসব লিখিত ও পারিপার্শ্বিক উপকরণ ব্যবহার করে টেক্সট পাঠের ধ্রুপদি নজির। এ এক পর্যালোচনাধর্মী সমালোচনা। ক্রিটিকেল থিংকিং এবং সাহিত্য-সমালোচনা – দু-অর্থেই রচনাটি সমালোচনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
‘ক্রিটিকেল থিংকার’ রণজিৎ গুহ পাঠের জন্য ‘সমালোচনা’ হতে পারে অন্যতম নির্ণায়ক চাবিশব্দ।
প্রথম প্রকাশ : সমকাল, ৫ মে ২০২৩